অনেকেই বলতে চায় ইমাম মাহমুদ যা বলছে তা তো এখনো মিলছে না। যারা এরকম বলে তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে আগামী কথনে বর্ণিত কিছু আলামতের কথা। আগামী কথনে বলা হয়েছে-
বিংশ শতকের বিংশ সনের কিছু করে হেরফের,
প্রকাশ ঘটিবে ভন্ড মাহদী ভূখণ্ড তুরস্কের।
সপ্ত বর্ণে নামের মালা ‘হা’ দিয়ে শুরু তাঁর,
খতমে থাকিবে ‘ইয়া’ সে মাহদীর মিথ্যা দাবিদার।
আগামী কথনের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছিল ২০২০ সালে কিছু হেরফের করে তুরস্ক থেকে একজন নিজেকে মাহদি দাবী করবে। ধারণা করা হয় সে হারুন ইয়াহিয়া। এখন প্রশ্ন হলো ২০২০ গিয়ে ২০২৩ সালও শেষ দিকে হারুন ইয়াইয়া তো এখনো নিজেকে মাহদী দাবী করেনি। তাহলে আগামী কথন ভুল ও মিথ্যা। এটি আগামী কথনের উপর বাড়াবাড়ি। আগামী কথনের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছিল হারুন ইয়াইয়া নিজেকে মাহদী দাবি করবে। কিন্তু মূল পুথি মালায় হারুন ইয়াহিয়ার কথা বা নাম প্রকাশ্য বলা হয়নি। শুধু ইংগিতে হা ও ইয়া এর কথা বলা হয়েছে। তেমনিভাবে সে যে ২০২০, ২১ সালেই মাহদী দাবি করবে সেটিও স্পষ্ট করে নিশ্চিত করে বলা হয়নি। শুধু ইঙ্গিতে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। আর ব্যাখ্যা ভুলও হতে পারে। তাইতো পবিত্র কুরআনুল কারীমে বলা হইছে-
حَتّٰۤی اِذَا اسۡتَیۡـَٔسَ الرُّسُلُ وَ ظَنُّوۡۤا اَنَّہُمۡ قَدۡ کُذِبُوۡا جَآءَہُمۡ نَصۡرُنَا ۙ فَنُجِّیَ مَنۡ نَّشَآءُ ؕ وَلَا یُرَدُّ بَاۡسُنَا عَنِ الۡقَوۡمِ الۡمُجۡرِمِیۡنَ ﴿۱۱۰﴾
অর্থঃ (তাদের ধ্বংস করে দেওয়ার কাজটি ততক্ষন পর্যন্ত বিলম্বিত করা হইছিলো) যতক্ষণ না রসূলরা সম্পূর্ণ নিরাশ হইছে এবং ফয়সালায় উপনীত হইছে যে, তাদেরকে সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করা হইছে। তারপর যখন সেই অবস্থা সৃষ্টি হয় তখন রসূলদের পক্ষে আমার সাহায্য গিয়ে হাজির হয়। অতঃপর আমি যাকে চাই তাকে
বাঁচাই, কিন্তু অপরাধীদের উপর থেকে আমার শাস্তি প্রতিরোধ করার আর কেউই থাকে না। (সূরা ইউসুফ, আঃ ১২:১১০)
অন্য অনুবাদে আছে- (হে নাবী! তোমার পূর্বেও এমন ঘটেছে যে,) শেষ পর্যন্ত রসূলগণ নিরাশ হয়েছে, আর লোকেরা মনে করেছে যে, তাদেরকে মিথ্যে কথা বলা হয়েছে, তখন তাদের (রসূলদের) কাছে আমার সাহায্য এসে পৌঁছেছে, এভাবেই আমি যাকে ইচ্ছে রক্ষা করি। অপরাধী সম্প্রদায় থেকে আমার শাস্তি কক্ষনো ফিরিয়ে নেয়া হয় না।
অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে-
وَ اِذۡ یَقُوۡلُ الۡمُنٰفِقُوۡنَ وَ الَّذِیۡنَ فِیۡ قُلُوۡبِهِمۡ مَّرَضٌ مَّا وَعَدَنَا اللّٰهُ وَ رَسُوۡلُهٗۤ اِلَّا غُرُوۡرًا ﴿۱۲﴾
অর্থঃ- এ অবস্থায় মুনাফিকরা এবং যাদের অন্তরে রোগ ছিলো, তারা বলছিলো: আল্লাহ এবং তার রসূল আমাদের যে ওয়াদা দিয়েছেন সেটা একটা প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয়। (সূরা আহযাব, আঃ ৩৩:১২)
অত্র আয়াতে কারীমা দুটিতে আজাব বিলম্বিত হওয়ার কথা বলা হয়েছে। এর মাধ্যমে ঈমানদারদের থেকে মুনাফিক ও অন্তরের রোগীদের পৃথক করাই মহান আল্লাহ তায়ালার উদেশ্য। উল্লিখিত প্রথম আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসীরে মাআরেফুল কুরআনের ৬৯৫ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে-
“পূর্ববর্তী উম্মাতদের অবাধ্যদেরকে লম্বা লম্বা অবকাশ দেয়া হয়েছে। এমন কি দীর্ঘদিন পর্যন্ত তাদের উপর আযাব না আসার কারণে পয়গম্বরগণ এরূপ ধারণা করে নিরাশ হয়ে পড়েছেন যে- আল্লাহ প্রদত্ত আযাবের সংক্ষিপ্ত ওয়াদার যে অবকাশ (সময়) আমরা নিজেদের অনুমানের ভিত্তিতে স্থির করে রেখেছিলাম, সে সময়ে কাফেরদের উপর আযাব আসবে না এবং সত্যের বিজয় প্রকাশ পাবে না। পয়গম্বরগণ প্রবল ধারণা পোষণ করতে থাকেন, অনুমানের মাধ্যমে আল্লাহর ওয়াদার সময় নির্ধারণ করার ব্যাপারে আমাদের বোধশক্তি ভুল করেছে। কারণ, আল্লাহ তায়ালা তো কোন নির্দিষ্ট সময় বলেনি। আমরা বিশেষ বিশেষ ইঙ্গিতের মাধ্যমেই একটি সময় নিদিষ্ট করে নিয়েছিলাম। এমনকি নৈরাশ্যজনক পরিস্থিতিতে তাঁদের কাছে আমার সাহায্য এসে যায় অর্থাৎ ওয়াদা অনুযায়ী কাফেরদের উপর আমার আযাব এসে যায়। এটা এক প্রকার ইজতেহাদী ভ্রান্তি। পয়গম্বরগণের দ্বারা এরূপ ইজতেহাদি ভ্রান্তি সম্ভবপর। তবে পয়গম্বর ও মুজতাহিদদের মধ্যে পার্থক্য এই যে পয়গম্বরগনের ক্ষেত্রে দীর্ঘ সময়ব্যাপী এরূপ ভুল ধারণার উপর স্থির থাকার সুযোগ দেয়া হতো না, বরং তাদেরকে বাস্তব বিষয় জ্ঞাত করে প্রকৃত সত্য ফুটিয়ে তোলা হতো। অন্যান্য মুজতাহিদদের জন্য এরূপ মযার্দা নেই। অত্র আয়াতে কারীমা থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় যে সময় নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে পয়গম্বরগণের পর্যন্ত ইসতেহাদি ভুল হতে পারে । আর ইমাম মাহমুদ ও সাহেবে কিরণ তো কোনো পয়গম্বর নয়। তাই তাদের ব্যাখ্যাও ভুল হতে পারে। আর কোন মুজতাহিদ ইজতেহাদ করতে গিয়ে ভুল করলেও একটি সওয়াব হয় আর সঠিক ইজতেহাদ করলে দুইটি সওয়াব হয়। তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই মনে রাখতে হবে মূল ঘটনা ঘটবেই কারণ ওহী ও ইলহাম আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে। আর আল্লাহ তায়ালার কথার কোন পরিবর্তন নেই। সঠিক সময়েই সবকিছু প্রকাশ ঘটবে ইনশাআল্লাহ।
ইমাম মাহমুদ নিজের মনগড়া কোন কথা বলেন না। ইমাম মাহমুদ শরীয়ত বিরোধী কোন কথা বললে যে কেউ সংশোধনের নিয়তে তা ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ইমাম মাহমুদ সব সময় বলেন। উনি যেহেতু মানুষ সুতরাং, তাঁরও ভুল হতে পারে। এমনকি ইমাম মাহদীরও ভুল হতে পারে। তবে আল্লাহ তায়ালা উনাদেরকে ইলহামের মাধ্যমে সংশোধন করবেন। আমরা ততক্ষণ পর্যন্ত ইমাম মাহমুদের কথা শোনতে ও মানতে বাধ্য, যতক্ষণ পর্যন্ত উনি আমাদেরকে শিরক ও বিদআতের আদেশ না করে। যেহেতু উনি আল্লাহ তায়ালা প্রদত্ত আমীর। তাই আমীরের আনুগত্য করাটাও আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ। যারা বলে ইমাম মাহমুদের কথা মিলছেনা। তাদের জন্য উপরের আয়াত দুটিতে জবাব রয়েছে। কিন্তু আমরা দেখি ইমাম মাহমুদ ইলহামের মাধ্যমে যেসব কথা বলেছেন তা হুবহু মিলে যাচ্ছে।
যেমন, ইমাম মাহমুদ আজ থেকে প্রায় তিনবছর আগে বলেছিলেন ব্যাংকগুলো দেউলিয়া হয়ে যাবে। আজকে ব্যাংকে বর্তমান অবস্থা কি? আজকে ব্যাংকগুলো খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে আছে। হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ খেলাপীর মাধ্যমে বাহিরে পাচার করা; কে অস্বীকার করতে পারবে।
ইমাম মাহমুদ আজ থেকে প্রায় দুই বছর পূর্বে বলেছিল একই সময় পৃথিবীতে বন্যা ও খরা এবং দুর্ভিক্ষ দেখা দিবে; তাও বাস্তবে হুবহু মিলে যাচ্ছে। বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা নিয়ে ইমাম মাহমুদ আজ থেকে প্রায় তিন বছর আগে বলেছিল- ২০২৩ সালের মাঝখান থেকে আস্তে আস্তে দেশের অবস্থা খারাপ হবে এবং ২০২৪ সালে জনগণ বুঝতে পারবে কি করতে হবে। অর্থাৎ তখন মানুষ নিজে থেকেই বাস্তবতা উপলব্ধি করে বলতে বাধ্য হবে গাজওয়াতুল হিন্দ কাছে না দূরে। এরকম সকল ক্ষেত্রেই ইমাম মাহমুদের কথা মিলে যাচ্ছে এবং যাবে; যেহেতু এসব কথা মূলত আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে সতর্কবার্তা।
কারন আল্লাহ তায়ালা সতর্ক না করে কোন জাতিকে ধ্বংস করেন না। আর বর্তমান সময়ে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে ইমাম মাহমুদ একজন সতর্ককারী। যদিও উনি কোন পয়গম্বর নয় বরং উনি বেলায়াতপ্রাপ্ত আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে গাজওয়াতুল হিন্দের মনোনীত আমীর।
এরপরও যারা মাহমুদের বিষয়ে বিতর্ক করতে চায়, তাদেরকে বলবো আমরাও অপেক্ষা করছি, আপনারাও অপেক্ষা করুন। অচিরেই আল্লাহ তায়ালা প্রমাণ করে দিবেন কারা সত্যবাদী ও কারা মিথ্যাবাদী।
আল্লাহ তায়ালার ভাষায়-
وَ قُلۡ جَآءَ الۡحَقُّ وَ زَهَقَ الۡبَاطِلُ ؕ اِنَّ الۡبَاطِلَ کَانَ زَهُوۡقًا ﴿۸۱﴾
বলোঃ সত্য এসেছে, মিথ্যা অপসারিত হয়েছে, আর মিথ্যাতো অপসারিত হবারই।
এ ক্ষেত্রে সূরা আর-রূমে বর্ণিত হযরত আবু বকর রাঃ ও উবাই ইবনে খালফের কথা স্মরণ করা যায়। কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে-
غُلِبَتِ الرُّوۡمُ ۙ﴿۲﴾
فِیۡۤ اَدۡنَی الۡاَرۡضِ وَ هُمۡ مِّنۡۢ بَعۡدِ غَلَبِهِمۡ سَیَغۡلِبُوۡنَ ۙ﴿۳﴾
فِیۡ بِضۡعِ سِنِیۡنَ ۬ؕ لِلّٰهِ الۡاَمۡرُ مِنۡ قَبۡلُ وَ مِنۡۢ بَعۡدُ ؕ وَ یَوۡمَئِذٍ یَّفۡرَحُ الۡمُؤۡمِنُوۡنَ ۙ﴿۴﴾
অর্থঃ রোমকরা পরাজিত হয়েছে; নিকটবর্তী এলাকায় এবং তারা তাদের পরাজয়ের পর অতিসত্ত্বর বিজয়ী হবে; কয়েক বছরের মধ্যে। পূর্বের ও পরের সব ফয়সালা আল্লাহরই। সেদিন মুমিনগণ আনন্দিত হবে। (সূরা রূম, আঃ ২-৪)
অত্র আয়াতে কারীমাগুলো ব্যাখ্যায় তাফসীরে মাআরেফুল কোরআন এর ১০৩৬-১০৩৭ পৃষ্ঠাতে বিস্তারিত ঘটনা বর্ণনা এসেছে। এখানে শুধু মূল ঘটনার সারমর্মের, দিকে ইঙ্গিত করা হলো-
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কায় অবস্থানকালে পারসিক ও রোমকদের মধ্যে যুদ্ধ সংগঠিত হয়। মুসলমানরা চাচ্ছিল রোমকরা জয়লাভ করুক। অপরদিকে মুশরিকরা চাচ্ছিল পারসিকরা জয় লাভ করুক।
ঘটনাক্রমে পারসিকরা জয় লাভ করে। এতে মক্কার মুশরিকরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল এবং মুসলমানদেরকে লজ্জা দিতে লাগল যে, এতে মুসলমানরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত হয়। সূরা রূমের প্রাথমিক আয়াতগুলো এই ঘটনা সম্পর্কেই অবতীর্ণ হয়েছে।
এসব আয়াতে ভবিষ্যৎবাণী করা হয়েছে যে, কয়েক বছর পরেই রোমকরা পারসিকদের বিরুদ্ধে বিজয়ী হবে। হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা) যখন এসব আয়াত শুনলেন তখন উবাই ইবনে খালফ এর সাথে বাজি ধরলেন যদি তিন বছরের মধ্যে রোমকরা বিজয়ী না হয়, তবে আমি তোকে দশটি উষ্ট্রী দেব। উভয় এতে সম্মত হল। এ কথা বলে হযরত আবু বকর রসূলুল্লল্লাহ (ﷺ) এর কাছে উপস্থিত হয়ে ঘটনা বিবৃত করলেন। রসূলে করীম (ﷺ) বললেন, আমি তো তিন বছরের সময় নির্দিষ্ট করিনি। কোরআনে এর জন্যে بِضۡعِ سِنِیۡنَ ব্যবহৃত হয়েছে।
কাজেই তিন থেকে নয় বছরের মধ্যে এই ঘটনা ঘটতে পারে। তুমি যাও এবং উবাইকে বল আমি দশটি উষ্ট্রীর স্থলে একশ উষ্ট্রী বাজি রাখছি কিন্তু সময়কাল তিন বছরের পরিবর্তে নয় বছর এবং কোন কোন রেওয়ায়েত মতে সাত বছর নির্দিষ্ট করেছি। (ইবনে জাবির, তিরমিজি)
অত্র ঘটনা থেকে যেটি লক্ষণীয় বিষয় ক্ষেত্রে আবু বকর (রা:) ও ভুল করেছেন কিন্তু রসূল (ﷺ) তাকে সংশোধন করে দিয়েছেন। তাই পবিত্র কুরআনুল কারিমের আয়াত ও তাফসীর থেকেই প্রমাণ পাওয়া যায় সময় নির্ধারণের ক্ষেত্রে নবীগণও ভুল করতে পারেন। কিন্তু আল্লাহু তায়ালা তাদের ওহীর মাধ্যমে সংশোধন করে দিয়েছেন। কিন্তু কেউ তাদের সমালোচনা করেনি।
ইমাম মাহমুদ ও সাহিবে কিরানেরও ভুল হতে পারে সময় নির্ধারণের। এক্ষেত্রে কিন্তু মূল ঘটনা অবশ্যই ঘটবে শুধু একটু সময়ের হের ফের হতে পারে। আর এর দ্বারা মুনাফিক ও অন্তরের রোগীদের আলাদা করাই আল্লাহর উদ্দেশ্য।
এক্ষেত্রে আরো স্মরণ রাখা দরকার যে হুদায়বিয়া সন্ধির প্রাক্কালের ঘটনা- আল্লাহর রসূল (ﷺ) স্বপ্নে দেখলেন উমরা করছেন। তিনি উমরার জন্য রওনা হল, তার সাথে ১৪০০ জন সাহাবী রওনা হয়েছিল। কিন্তু সে বছর আল্লাহর রসূল (ﷺ) মুশরিকদের বাঁধায় উমরা না করেই ফিরে আসেন। আর এই ঘটনায় সকল সাহাবী বিশেষ করে উমর (রা:) বিশেষভাবে কষ্ট পান এবং আবু বকর ছিদ্দিক (রা:) এর সান্তনায় শান্ত হন। ঘটনাটি বিস্তারিত জানলে আরো বুঝা যায় যে রসূল (ﷺ) যে উমরা করার স্বপ্ন দেখেছিলেন তা বাস্তবে না হওয়ার কারণেও মুমিনদের মধ্যে সংশয় সন্দেহ দেখা দিয়েছিল। তখন উমার রাঃ এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাও করেন যে আপনি কি আমাদের উমরা করার কথা বলেছিলেন না? তখন রসূল (ﷺ) উত্তর দেন যে- নাবী কারীম (ﷺ) বললেন, (بَلٰى، فَأُخْبِرْتُكَ أِنَّا نَأْتِيَهُ الْعَامَ؟) ‘অবশ্যই, কিন্তু আমি কি এ কথা বলেছিলাম যে, আমরা এ বছরই আসব।’ তিনি উত্তর করলেন, ‘না’। নাবী (ﷺ) বললেন, (فإنك آتيه ومطوف به) ‘যাহোক ইনশাআল্লাহ্ তোমরা আল্লাহর ঘরের নিকট আসবে এবং তাওয়াফ করবে।(১)
এবং পরবর্তী বছর যখন উমরা করতে যান তখন বুঝা যায় এটিই সেই স্বপ্নের ব্যাখ্যা যা প্রথম বছর বাস্তবায়িত হয়নি।
এসব ঘটনার মধ্যে জ্ঞানীদের জন্য বিশেষ নসিহা রয়েছে। শুধু পাপাচারী ও মুনাফিকরা এসব ঘটনা নিয়ে সন্দেহে পতিত হয়। তবে বিশ্বাসীদের জন্য অবশ্যই মহাপুরস্কার রয়েছে। তাই বিশ্বাসীদের বলবো বিশ্বাসে অটল থাকুন আল্লাহর সাহায্য খুবই নিকটে।
اَلَاۤ اِنَّ نَصۡرَ اللّٰهِ قَرِیۡبٌ
অর্থ: জেনে রাখো, আল্লাহর সাহায্য খুবই নিকটে। (সূরা আল-বাকারাহ, আঃ ২:২১৪)
টীকা (১): হুদায়াবিয়া শর্ত সমূহের মধ্যে দুটি শর্ত স্পষ্টতঃ এ প্রকারের ছিল যা মুসলিমগণের মনে দারুন দুঃখ, বেদনা, হতাশা ও বিষণ্ণতার ভাব সৃষ্টি করেছিল। সেগুলো হচ্ছে (১) বিষয়টি ছিল, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছিলেন যে, তিনি আল্লাহর ঘরের নিকট গমন করবেন এবং তাওয়াফ করবেন, কিন্তু পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে তাওয়াফ না করেই মদীনা ফিরে যাওয়ার শর্তে তিনি সম্মতি জ্ঞাপন করেন। (২) দুঃখ-বেদনার দ্বিতীয় বিষয়টি ছিল, তিনি আল্লাহর রাসূল (ﷺ) এবং সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর দ্বীনকে জয়যুক্ত করবেন বলে তিনি ঘোষণাও দিয়েছিলেন, অথচ কুরাইশগণের চাপে পড়ে কী কারণে তিনি সন্ধির এ অবমাননাকর শর্তে সম্মতি জ্ঞাপন করলেন তা কিছুতেই মুসলিমগণের বোধগম্য হচ্ছিল না। এ দুটি বিষয় মুসলিমগণের মনে দারুণ সংশয় সন্দেহ এবং শঙ্কার সৃষ্টি করেছিল। এ দুটি বিষয়ে মুসলিমগণের অনুভূতি এতই আঘাতপ্রাপ্ত ও আহত হয়েছিল যে বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করে এর সুদূর প্রসারী ফলাফল সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা করার মতো মানসিক ধৈর্য তাঁদের ছিল না। ভাবানুভূতির ক্ষেত্রে তাঁরা সকলেই প্রায় ভেঙ্গে পড়েছিলেন এবং সম্ভবত উমার (রাঃ) আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিলেন সব চাইতে বেশী।
তিনি নাবী কারীম (ﷺ)-এর দরবারে উপস্থিতত হয়ে আরয করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) আমরা কি সত্যের উপর দন্ডায়মান নই এবং কাফিরেরা বাতিলের উপর?
নাবী কারীম (ﷺ) উত্তর দিলেন, ‘অবশ্যই।’
তিনি পুনরায় আরয করলেন, ‘আমাদের শহীদগণ জান্নাতে এবং তাদের নিহতগণ কি জাহান্নামে নয়?’ ‘তিনি বললেন, কেন নয়।’
উমার বললেন, ‘তবে কেন আমরা আল্লাহর দ্বীন সম্পর্কে মুশরিকদের চাপে পড়ব এবং এমন অবস্থায় প্রত্যাবর্তন করব যে, এখনও আল্লাহ তা‘আলা আমাদের ও তাদের মধ্যে কোনই ফয়সালা করেন নি?’
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, (يَا ابْنَ الْخَطَّابِ، إِنِّيْ رَسُوْلُ اللهِ وَلَسْتُ أَعْصِيَهُ، وَهُوَ نَاصِرِيْ وَلَنْ يُضَيِّعَنِيْ أَبَداً)
ওহে খাত্তাবের সন্তান! আমি আল্লাহর রাসূল এবং কখনই তাঁর অবাধ্য হতে পারব না। আমি বিশ্বাস করি যে সকল প্রয়োজনে তিনিই সাহায্য করবেন এবং কখনই আমাকে ধ্বংস হতে দেবেন না।’
উমার (রাঃ) বললেন, ‘আপনি কি আমাদের বলেন নি যে, আপনি আল্লাহর ঘরের নিকট গমন করবেন এবং তাওয়াফ করবেন?’
নাবী কারীম (ﷺ) বললেন, (بَلٰى، فَأُخْبِرْتُكَ أِنَّا نَأْتِيَهُ الْعَامَ؟) ‘অবশ্যই, কিন্তু আমি কি এ কথা বলেছিলাম যে, আমরা এ বছরই আসব।’
তিনি উত্তর করলেন, ‘না’
নাবী (ﷺ) বললেন, (فإنك آتيه ومطوف به) ‘যাহোক ইনশাআল্লাহ্ তোমরা আল্লাহর ঘরের নিকট আসবে এবং তাওয়াফ করবে।
এরপর উমার (রাঃ) ক্রোধে ও অভিমানে অগ্নিশর্মা হয়ে আবূ বাকর সিদ্দীক (রাঃ)-এর নিকট গিয়ে উপস্থিত হলেন এবং তাকেও সে সব কথা বললেন যা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বলেছিলেন। প্রত্যুত্তরে আবূ বাকরও (রাঃ) সে সব কথাই বললেন যা রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেছিলেন এবং পরিশেষে এটুকুও বললেন যে, ধৈর্য সহকারে নাবী (ﷺ) পথের উপর দন্ডায়মান থাক যতক্ষণ পর্যন্ত সত্য সমাগত না হয়। কেননা আল্লাহর শপথ তিনি সত্যের উপরেই প্রতিষ্ঠিত রয়েছেন।’
এরপর(إِنَّا فَتَحْنَا لَكَ فَتْحًا مُّبِيْنًا) ‘আমি তোমাকে দিয়েছি স্পষ্ট বিজয়।’ [আল-ফাতহ (৪৮) : ১] আয়াত অবতীর্ণ হয়। যার মধ্যে এ সন্ধিকে সুস্পষ্ট বিজয় প্রমাণ করা হয়েছে। এ আয়াতে কারীমা অবতীর্ণ হলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) উমার (রাঃ)-কে আহবান করলেন এবং আয়াতটি পড়ে শোনালেন। তিনি তখন বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমরা কি একে বিজয় বলতে পারি?
নাবী কারীম (ﷺ) বললেন, ‘হ্যাঁ’’।
এতে তিনি সাত্ত্বনা লাভ করলেন এবং সেখান থেকে চলে গেলেন।
– (আর রাহীকুল মাখতুম -আল্লামা সফিউর রহমান মোবারকপুরী (রহঃ); হুদায়বিয়াহ সন্ধি চু্ক্তির বিস্তারিত বিবরণের উৎসগুলো হচ্ছে যথাক্রমে ফাতহুল বারী ৭ম খন্ড ৪৩-৪৫৮৮, সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড ৩৭৮-৩৮১পৃ, ২য় খন্ড, ৫৯৮-৬০০ ও ৭১৭ পৃঃ, সহীহুল মুসলিম ২য় খন্ড ১০৪-১০৬ পৃঃ। ইবনু হিশাম ২য় খন্ড ৩০৮-৩২২ পৃঃ। যাদুল মা‘আদ ২য় খন্ড ১২২-১২৭ পৃঃ, মুখতাসারুস সীরাহ (শাইখ আব্দুল্লাহ রচিত) ২০৭-৩৫০ পৃঃ, ইবনু জাওযী লিখিত তারীখে উমার বিন খাত্তাব ৩৯-৪০ পৃঃ।)