বিসমিল্লাহির রহমানীর রহীম
এই লেখায় যেসকল প্রশ্নের উত্তর পাবেন ইনশা আল্লাহ-
১। কুরআন-হাদিস মতে ইমাম বা নেতা হওয়ার শর্তসমূহ।
২। জিহাদে অংশগ্রহণে অক্ষম তথা মা’জুর ব্যক্তি কি ইমাম বা নেতা হতে পারে?
৩। একজন ব্যক্তির জিহাদে অংশগ্রহণের শর্তসমূহ।
ইতিহাসে দেখা যায়- আল্লাহর পক্ষ হতে মনোনীত যখনই কেউ এসেছে, যখনই হকপন্থী কেউ বের হয়েছে তখন তাদের বিরোধিতা করার জন্য বিভিন্ন শ্রেণীর লোক তৈরি হয়েছে। তাদের একটা শ্রেণী হচ্ছে জ্ঞানপাপী আলীমগণ তথা কথিত শায়েখগণ। এই শায়েখগণ বিরোধিতা করার জন্য সর্বদা কুরআন-হাদিস থেকেই দলিল(!) দিয়ে থাকে। আসলে তা হচ্ছে- যেখানের দলিল ওইখানে না লাগিয়ে ভিন্ন যায়গায় প্রয়োগ ও অপব্যাখ্যা। মাহমুদ সম্পর্কে সেই অপব্যাখ্যার জবাব দেওয়ার আগে তাদের সেই অপব্যাখ্যাগুলো উল্লেখ করে নিচ্ছি-
(ক) সবাই জানে মাহমুদ মা’জুর তথা শারীরিকভাবে ত্রুটিযুক্ত, অক্ষম ও দুর্বল একজন ব্যক্তি এবং তিনি যে এমন হবেন তা হাদিসেই উল্লেখ এসেছে। বিরোধিতা করার জন্য তাঁরা বলে- মা’জুর তথা (শারীরিক ও মানসিক ভাবে) অক্ষম কোন ব্যক্তি মুসলিমদের/মুজাহিদদের নেতা হতে পারবে না। এবং প্রশ্ন করে ইমাম হওয়ার শর্তসমূহ ও ফিকহ এর কিতাব পড়েছি কিনা। তাঁরা তখন ‘শত্রুদের সাথে জিহাদে/সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণে একজন ব্যক্তির শর্তাবলী’ দলিল হিসেবে পেশ করে থাকে কুরআন ও হাদিস থেকে। যেমনঃ-
শারীরিকভাবে অক্ষম ও দুর্বল ব্যক্তির ওপর জিহাদ ফরজ নয়। আল্লাহ তাআলা বলেন:
لَيْسَ عَلَی الأَعْمَی حَرَجٌ وَلَا عَلَی الْأَعْرَجِ حَرَجٌ وَلَا عَلَی الْمَرِيضِ حَرَجٌ
(জিহাদে অংশগ্রহণ না করাতে) অন্ধের জন্য কোনো গুনাহ নেই ; খোঁড়ার জন্য কোনো গুনাহ নেই এবং রুগ্ন ব্যক্তির জন্যও কোনো গুনাহ নেই। (সূরা ফাতহ: ১৭)
অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন: لَيْسَ عَلَی الضُّعَفَاء وَلاَ عَلی الْمرْضَی
(যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করাতে) দুর্বল লোকদের কোনো গুনাহ নেই এবং অসুস্থ লোকদেরও কোনো গুনাহ নেই….। (সূরা তাওবা: ৯১)
এই দুই আয়াতসহ অন্যান্য আয়াত, হাদিস ও শরিয়তের মূলনীতির আলোকে ফুকাহায়ে কেরাম নিম্নোক্ত কয়েক শ্রেণির ব্যক্তিকে মাজুর বা অক্ষম বলে গণ্য করেছেনঃ
১. অন্ধ। ২. খোঁড়া। ৩. অত্যধিক রুগ্ন। ৪. অতিশয় দুর্বল। ৫. অতি বৃদ্ধ ৬. পঙ্গু।
উল্লেখ্য যে, এই সকল ব্যক্তি তখনই মাজুর ও অক্ষম বলে গণ্য হবে যখন এসব ওজর ও সমস্যা এমন পর্যায়ের হবে যে, তাদের পক্ষে আর যুদ্ধ করা সম্ভব নয়। অতএব, হালকা-ঝাপসা দেখে, সামান্য খোঁড়া কিন্তু যুদ্ধ করতে সক্ষম, হালকা সাধারণ অসুস্থ, বৃদ্ধ হলেও এত বেশি বৃদ্ধ নয় যে যুদ্ধ করতে অক্ষম, হাত-পায়ে ঈষৎ বিকলাঙ্গতা আছে কিন্তু যুদ্ধে সক্ষম এ ধরনের লোক অক্ষম হিসাবে গণ্য হবে না।
– (বাদায়িউস সানায়ি : ৬/৫৮-৫৯; ফাতাওয়ায়ে শামি: ৬/২০১-২০৫; আল-মুগনি: ১০/৩৬৭)
এর সাথে আরো বিষয় উল্লেখ করি যে- শিশু, যুদ্ধে অপারদর্শী কিশোর ও শারীরিকভাবে ক্রুটিহীন কিন্তু জ্ঞানহীন বা পাগল, তাঁর জন্যও জিহাদ নেই। সাথে আর্থিক সক্ষমতা ও বাহনের বিষয়ও নির্ভর করে।
(খ) এটা ছাড়া তাঁরা সূরা বাকারায় উল্লেখিত তালুত জালুত এর ঘটনা উপস্থাপন করে বলে যে- তালুতকে যে আল্লাহ যুদ্ধের জন্য নেতা মনোনীত করেছেন, তাঁর ব্যাপারে বলা হয়েছে তিনি সুঠামদেহী। আল্লাহ তো তখন দুর্বল, অক্ষমকে নেতা বানাননি।
তাদের বর্ণিত বিষয়ের যুক্তি খণ্ডনঃ
——————————-
তাঁরা যেসকল দলিল কুরআন ও হাদিস থেকে পেশ করে থাকে তা অবশ্যই গ্রহণযোগ্য বিষয়। তবে সর্বপ্রথম এখানে দুইটি বিষয় আলাদা করতে হবে। তা হচ্ছে-
১। নেতা অর্থাৎ ইমাম বা আমীর বা খলীফা।
২। যুদ্ধের সেনাপতি, সালার (সহ-সেনাপতি বা কমান্ডার) ও যুদ্ধে সরাসরি অবতীর্ণ হওয়া সাধারণ যোদ্ধা।
তাঁরা যেসকল দলিল দিয়েছে তা কি এই দুই শ্রেণীর জন্যই প্রযোজ্য বলে ঘোষণা দিচ্ছে? যদি সেটা করে তাহলে তাঁরা মারাত্মক ভুল করছে। যদিও আমি আগেই বলে নিয়েছি যে শুধুমাত্র মাহমুদকে নেতা হিসেবে মানতে না চাওয়ার কারণেই তাঁরা এসকল দলিল ব্যবহার করছে ভুল ভাবে।
কারণ সঠিক হচ্ছে- শুধু মাত্র যেসকল যোদ্ধা সশস্ত্রভাবে যুদ্ধের ময়দানে অবতীর্ণ হবে তারাই শুধুমাত্র সেই সকল শর্তসমূহের মধ্যে পড়বে অর্থাৎ তাঁদের সক্ষম হতে হবে। এছাড়া নয়। তাঁরা এই দলিল কোথায় পেল যে যারা সরাসরি যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে অক্ষম সে নেতা বা ইমাম বা আমীরও হতে পারবে না? তাঁরা জিহাদের জন্য নেতা বা আমীর বানানোর এই শর্ত কোথায় পেল? নাকি এমন কিছু যে- যিনি নেতা বা আমীর হবেন তাকে যুদ্ধের ময়দানে সরাসরি নামতেই হবে, এরকমও কি কোন শর্ত বা শরীয়তের কোন দলিল আছে? কুরআন-হাদিসে নেতা মনোনীত হওয়ার যে শর্তসমূহ আছে আমি একটু পরই তা দলিল সহ উল্লেখ করছি কিন্তু তাঁর আগে আমি এই বিষয়ের কিছু বাস্তব উদাহরণ উল্লেখ করছি যুক্তি দিয়ে। যেহেতু তাঁরা- যুদ্ধে সরাসরি অবতীর্ণ যারা হতে পারবে না অক্ষমতার কারনে তাদের শর্ত কে টেনে নেতৃত্বের উপর নিয়ে গেছে তাই কিছু উদাহরণ-
(ক) যখন রসূল সঃ জীবিত ছিলেন, তখন তিনি ছিলেন মুসলিমদের নেতা। তিনি মৃত্যুর আগ সময়তেও জিহাদ নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। তখন জিহাদ পরিচালনার নেতা তিনিই ছিলেন। শেষ সময়ে তিনি যখন মুমূর্ষু অসুস্থ অবস্থায় বিছানায় ছিলেন তখনও তিনি যুদ্ধে জন্য সেনাপতি নিযুক্ত করে মুজাহিদ দলকে যুদ্ধে পাঠানোর জন্য ব্যস্ত ছিলেন। এই বাহিনীর সেনাপ্রধান হিসেবে নিযুক্ত করেন উসামা বিন যায়েদ রা. কে। সে সময় উসামা রা. এর বয়স ১৯ পার হয় নি। তাই অনেক সাহাবারা নবীজিকে বলেছিলেন আমির বা সেনাপ্রধান পরিবর্তন করে দিতে।
তখন নবীজি তাদেরকে বললেন, আজ যদি তোমরা তার নেতৃত্বের উপর আপত্তি উত্থাপন কর (এটা আশ্চর্যের কিছু নয়, কেননা) এর পূর্বে তোমরা তার পিতার নেতৃত্বের ওপরেও আপত্তি তুলেছিলে। আল্লাহর শপথ! তার পিতা ছিল এ নেতৃত্বের যোগ্যতম ব্যক্তি এবং সে ছিল আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয়।” নবীজি ইন্তিকালের দুইদিন আগে খুব জোর দিয়ে বলেছেন, তোমরা উসামার বাহিনীকে প্রেরণ করে দাও। নবীজি উসামা রা. কে বলেছিলেন, তোমার পিতার শাহাদাতস্থলের দিকে বেরিয়ে পড়ো। আর আমি তোমাকে এই বাহিনীর সেনাপ্রধান নিযুক্ত করলাম। হযরত আবু বকর রা. খেলাফতের আসনে আরোহণের পর সর্বপ্রথম তিনি গুরুত্বারোপ করে উসামার বাহিনীকে প্রেরণ করার। কারণ নবীজি তাড়াতাড়ি এই বাহিনীকে পাঠাতে বলেছিলেন।
এখন তাদের কথা অনুযায়ী যদি নেতা হওয়ার শর্ত এই হয় শারীরিকভাবে সক্ষম তাহলে দেখা যায় রসূল সঃ তখন ছিলেন প্রচণ্ড অসুস্থ ও দুর্বল এবং তিনি জিহাদে অংশগ্রহণের জন্য তখন অক্ষম ছিলেন যেরকম টা কুরআন-হাদিসে বলা আছে, তাতে কি তাঁর নেতৃত্ব কেটে গেছে? বা নেতা হওয়া থেকে কি অযোগ্য হয়ে গেছেন? তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মুসলিমদের নেতা ছিলেন এবং তারপর তাঁর খলীফাগণ।
এবার তাঁরা বলবে যে আমরা এই নেতাকে বুঝাই নি আমরা বুঝিয়েছি যুদ্ধে নেতা দ্বারা যুদ্ধের সেনাপতিকে। যেমন উসামা ইবনে যায়েদ রাঃ। তো মাহমুদ কি যুদ্ধের সেনাপতি হবে এরকম দলিল পেয়েছেন কোথাও? উল্টা দলিল রয়েছে যে মাহমুদ হবেন ইমাম বা আমীর তথা নেতা এবং তাঁর সহচর বন্ধু ও মূল সেনাপতি হবে সাহেবে কিরান। মূল সেনাপতি বলার কারণ তাঁর আরো সেনাপতি থাকবে।
এবার সেনাবাহিনীর সেনাপতির আরেকটি ঘটনা উল্লেখ করছি-
(খ) চৌদ্দ হিজরীর মুহররম মাসের কথা। মুসলিম বাহিনী সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাসের নেতৃত্বে কাদেসিয়ার ইরানী বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত। ইরানী বাহিনীর সেনাপতি ছিলেন মহাবীর রুস্তম। আজ যুদ্ধের দ্বিতীয় দিন। তুমুল যুদ্ধ চলছে। অনেকে শহীদ হয়েছেন। আবার অনেকে আহত হয়ে শিবিরে চিকিৎসাধীন আছেন। সা‘দ বিন্ আবি ওয়াক্কাছ “অসুস্থ, তাই ময়দানে যেতে পারেন নি”। কাদেসিয়ার নিজ বাসস্থানের ছাদের উপর থেকে যুদ্ধের দিক নির্দেশনা দিচ্ছিলেন। অপর যায়গায় এসেছে- যুদ্ধের পূর্বে সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাছ (রাঃ) অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তিনি বাহনে আরোহণ করতে অক্ষম হয়ে গেলেন। ফলে তিনি যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব দিলেন (কমান্ডার) খালিদ ইবনু আরফাত্বাহ (রাঃ)-কে এবং নিজে ক্বিদ্দীস ভবনের ছাদে উঠে যুদ্ধ পর্যবেক্ষণ ও খালিদ ইবনু আরফাত্বাহকে নির্দেশনা দিতে থাকলেন। অর্থাৎ তিনি যুদ্ধের ময়দানে নামতে অক্ষম তবুও অসুস্থ অবস্থায়ও যুদ্ধ পরিচালনা করতে থাকলেন।
বিস্তারিতঃ এ যুদ্ধের প্রধান সেনাপতি ছিলেন সা‘দ বিন আবী ওয়াক্কাছ (রাঃ)। যুদ্ধের কমান্ডার ছিলেন খালিদ ইবনু আরফাতাহ (রাঃ)। ডান বাহুর সেনাপতি ছিলেন আব্দুল্লাহ ইবনু মু‘তাম (রাঃ) ও বাম বাহুর অশ্বারোহী দলের সেনাপতি ছিলেন শুরাহবীল ইবনু সামত্ব (রাঃ)। আর পদাতিক বাহিনীর সেনাপতি ছিলেন মুগীরা ইবনু শু‘বাহ (রাঃ)। হাশেম ইবনু উতবা বিন আবী ওয়াক্কাছ (রাঃ) ছিলেন সিরিয়া থেকে আগত সৈন্যদের সেনাপতি। কা‘কা‘ ইবনু আমর তামীমী (রহঃ) তাঁকে নেতৃত্বে দানে সাহায্য করেন। অন্ধ ছাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতূম (রাঃ) ছিলেন যুদ্ধের পতাকাবাহী। উমার বিন খাত্তাব রাঃ ছিলেন তখন মুসলিমদের আমীর তথা খলীফা। তিনি নিজেই এ যুদ্ধের সেনাপতি হয়ে যেতে চেয়েছিলেন কিন্তু পরে সা‘দ বিন আবী ওয়াক্কাছ রাঃ কে সেনাপতি করে পাঠান। (সামী আব্দুল্লাহ মাগলূছ, আত্বলাসুল খলীফা ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ), পৃঃ ৭২;)
এখন আপনারা একটু লক্ষ্য করেন, যেসকল লোকেরা বলে যে (কিছুদিন আগেই একজন বলল), মাজুর তথা অক্ষম লোকে কি যুদ্ধের নেতৃত্ব দিবে? কোন মাজুর ব্যক্তি কি যুদ্ধের নেতৃত্ব দেয়? ইমাম হওয়ার শর্ত কি সেগুলো আমাদের শিখাতে চায় তাদের বলব, এই দুইটি ঘটনা দিয়ে কি তাদের মাথায় কিছু ঢুকেছে? নেতৃত্ব দেওয়ার শর্ত আর যুদ্ধের ময়দানে সরাসরি শত্রুর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া যোদ্ধা ব্যক্তির শর্ত যে এক না। আর নাহলে তো সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস অসুস্থ হয়ে অক্ষম হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে সেনাপতির পদ থেকে সরিয়ে ফেলা দরকার হতো। আর শুধু সেনাপতির পদ কেন, অসুস্থতাঁর কারণে সে যেমন অক্ষম হয়েছে তাতে সে তখন সাধারণ সৈন্য হওয়ারও যোগ্য ছিলনা, শর্তানুযায়ী। তিনি যুদ্ধের ময়দানে সরাসরি নামেন নি অক্ষমতার কারণে আর একারণে তিনি আল্লাহর কাছে পাকড়াও ও হবেন না। কারণ সরাসরি যুদ্ধের ময়দানে নামার সেই শর্তের মধ্যে পড়ে যায়। বিস্তারিত ঘটনা সিরাতে রয়েছে।
এই যুদ্ধের জন্য মূল পরিকল্পনা কিন্তু নিয়েছিলেন আমীরুল মু’মিনীন খলীফা উমার ইবনুল খাত্তাব রাঃ। তিনিই এখানে নেতা এবং এখানে কাদেসিয়া যুদ্ধের মূল সেনাপতি সা’দ বিন আবী ওয়াক্কাছ, (তিনি মুসলিমদের আমীর বা খলীফা নয়) যে কিনা অসুস্থ হয়ে যুদ্ধের মাঠে থাকার বিষয়ে পর্যন্ত অক্ষম হয়ে গিয়েছিল। এরপরও কি তাঁর সেনাপতি বা সেনাপ্রধানের পদবি কেটে গেছিল? তিনি কি যুদ্ধ পরিচালনা করেন নি বা করতে পারেন নি? এমনকি তিনি যদি সরাসরি যুদ্ধের ময়দানে থাকতেন তাও যুদ্ধের ময়দানে নিজে অবতীর্ণ হওয়া, যুদ্ধ করা তাঁর উপর শর্ত হতো না। কারণ তিনি তখন যুদ্ধের সেনাপতি আর নিয়ম হচ্ছে তিনি কমান্ড দিবেন অন্যরা যুদ্ধ করবে। আপনাদের কথামত যুদ্ধে নেতা হওয়ার শর্ত কি তাঁর উপর খাটে না? তিনি কি যুদ্ধের সেনাপতি হওয়ার অযোগ্য হয়ে যায় না? আসলে আপনারা নিজেদের মত দলিল ও অপব্যাখ্যা বানিয়ে নিয়েছেন বিরুদ্ধাচারণ করার জন্য।
এখানে একটি বিষয় সাথে উল্লেখ করতে চাই যে- সেনাপতি সক্ষম হলে সরাসরি ময়দানে যুদ্ধ করতে পারেন এবং শহীদও হতে পারেন এবং ইতিহাসে এটি পাওয়া যায় যে এক যুদ্ধে পরপর তিন মুসলিম সেনাপতি শহীদ হন, কিন্তু তা অপরিহার্য নয়। সেই যুদ্ধে মুসলিমদের সংখ্যা খুবই কম ছিল এবং সেই সেনাপতি যুদ্ধে সক্ষম হওয়ায় তাঁরা ময়দানে সরাসরি যুদ্ধ করেন এবং শহীদ হন।)
আমি ইসলামের যুগের দুইটি ঘটনা উল্লেখ করে দেখিয়েছি। এবার আসুন বর্তমান যুগের এক মুসলিম বাহিনীর নেতাকে নিয়ে কথা বলি যিনি হচ্ছেন ইস-রা-য়েলের সাথে হামাসের যুদ্ধ শুরুর মূল পরিকল্পনাকারী ও কমান্ডদাতা। নাম তাঁর মুহাম্মাদ দেইফ।
(গ) বিস্তারিতঃ রয়টার্সের মতে, ঘটনার সূত্রপাত হয় দুই বছর আগে ২০২১ সালে মে মাস থেকে। তখন পবিত্র রমজান মাসে ইসলামের তৃতীয় পবিত্রতম স্থান আল আকসা মসজিদে ইসরায়েলি বাহিনীর হামলা, প্রার্থনারতদের মারধর, তাদের উপর হামলা, বয়স্ক ও যুবকদের মসজিদ থেকে টেনে বের করার দৃশ্য আরব এবং মুসলিম বিশ্বকে ক্ষুব্ধ করেছিল। মূলত তখন থেকেই এই হামলার পরিকল্পনা শুরু হয় বলছে রয়টার্স। হামাসের সামরিক শাখার প্রধান মোহাম্মদ দেইফ এই অভিযানের পরিকল্পনা শুরু করেছিলেন বলে জানায় হামাসের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র। লিঙ্ক- https://www.deshrupantor.com/459367/who-is-the-leader-of-hamas-and-who-masterminded-th
মোহাম্মদ দেইফ খুব কমই কথা বলেন। কখনও জনসমক্ষে উপস্থিত হন না। গত শনিবার যখন হামাসের টিভি চ্যানেল থেকে ঘোষণা করা হয়: আর কিছুক্ষণের মধ্যেই দেইফ বক্তব্য রাখবেন; ফিলিস্তিনিরা জানত বড় কিছু ঘটছে। তাকে হত্যা করতে পাঁচ বার গুপ্ত হত্যার চেষ্টা চালিয়েছে ইসরায়েল। একবার অল্পের জন্য বেঁচে গেলেও এক পা ও এক চোখ হারান। এর পর থেকে চলাফেরা করেন হুইল চেয়ারে। সর্বশেষ ২০২১ সালেও তাকে হত্যার চেষ্টা ব্যর্থ হয়। ইসরায়েলের বিমান হামলায় সাত মাসের ছেলে, তিন বছরের মেয়ে ও স্ত্রীকে হারিয়েছেন। তিনি হামাসের সামরিক শাখা আল-কাশিম ব্রিগেডের প্রধান মোহাম্মদ দেইফ। মোহাম্মদ দেইফ গত শনিবার ইসরায়েলে অতর্কিত হামলার মূল পরিকল্পনাকারী। গত কয়েক দশক ধরে ইসরায়েলের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ ব্যক্তিদের তালিকায় সবার ওপরে আছে তার নাম। লিঙ্ক- https://m.somewhereinblog.net/mobile/blog/baundele/30354200
ইউটিউব লিঙ্ক – https://www.youtube.com/watch?v=ZMKPnsVVYbM
সামরিক শাখার কমান্ডার যিনি এক চোখ, এক পা হারিয়েছেন এবং হুইল চেয়ারে চলাফেরা করেন। তিনি অক্ষম ও মাজুর ব্যক্তি। কোন শাখা! তাও আবার সামরিক শাখার নেতা। তিনিই নাকি পরিকল্পনাকারী ও কমান্ডদাতা। তো কি বুঝলেন? তিনি হয়তো সরাসরি যুদ্ধে নামেন নি, নামার সক্ষমতাও নেই, কিন্তু নেতৃত্বের গুণাবলী থাকায় ইস-রা-য়েলের মত একটি শক্তিশালী জাতির বিরুদ্ধে কি করেছে সবাই আজ দেখছে। তাকে কি শর্তের মধ্যে দিয়ে নেতৃত্ব দিয়ে বাহির করতে পারলো না তাদের আলেমরা বা আপনারা? তাঁরা কি আপনাদের দেওয়া শর্ত জানে না? অবশ্যই জানে, কিন্তু যেখানে যে দলিল লাগানোর দরকার সেখানেই তাঁরা লাগায়, অপব্যাখ্যা-তাব্যিল করে না।
তাই আবারো বলছি- মাহমুদকে কোথাও হাদিসে ময়দানে নেমে যুদ্ধ করা যোদ্ধা বলা হয় নাই যে তাঁর উপর যোদ্ধা হওয়ার শর্ত লাগাবেন, এমনকি সেনাপতিও বলা হয় নাই। তাকে ইমাম, আমীর তথা নেতা বলা হয়েছে। যিনি যুদ্ধে নেতৃত্ব দিবেন আর ময়দানে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য তাঁর সেনাপতি থাকবে। সবচেয়ে সহজ ফিকাহ শিক্ষা বইতেও এই বিষয়ে খুব সুন্দর লেখা হয়েছে-
“(১) যোদ্ধাদের প্রতি আমীরের কর্তব্য: যুদ্ধে পাঠানোর আগে ইমাম তার সৈন্যবাহিনীকে ভালোভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে নিবেন, নিরাশ, বিপদকালে ধোকাকারী ও গুজব রটনাকারীকে যুদ্ধে যেতে বারণ করবেন, অতিপ্রয়োজন ব্যতিত কাফিরের থেকে সাহায্য চাইবে না, যুদ্ধের রসদ সামগ্রী যোগাড় করে দিবেন, তিনি তার সৈন্যবাহিনীর ধীর-স্থিরভাবে চালাবেন, তাদের জন্য সুন্দর জায়গা নির্বাচন করবেন, সেনাবাহিনীকে ঝগড়া ফাসাদ ও গুনাহের কাজ থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দিবেন, তাদের মন মানসিকতা চাঙ্গা ও শক্তিশালী হয় এমন কথা বলবেন, তাদেরকে শহীদের মর্যাদার ফযীলত বর্ণনা করে উৎসাহিত করবেন, ধৈর্যের আদেশ দিবেন, সৈন্যবাহিনীকে কয়েকটি দলে ভাগ করবেন, তাদের জন্য মনিটর ও পাহারাদার নিযুক্ত করবেন, শত্রুর খোঁজ খবর নিতে গুপ্তচর পাঠাবেন, সৈন্যদের প্রয়োজন অনুসারে যাকে ইচ্ছা তিনি তাকে আনফাল তথা যুদ্ধে প্রাপ্ত সম্পদ বণ্টন করবেন এবং জিহাদের বিষয়ে দীন সম্পর্কে অভিজ্ঞ লোকদের সাথে পরামর্শ করবেন।
(২) আমিরের প্রতি সেনাবাহিনীর দায়িত্ব ও কর্তব্য: সৈন্যবাহিনীর ওপর ফরয হলো ইমাম তথা আমিরের আনুগত্য করা, তার সাথে ধৈর্যসহকারে থাকা, আমিরের অনুমতি ব্যতিত যুদ্ধ না করা; তবে হঠাৎ করে শত্রু আক্রমণ করলে তাদের দ্বারা ক্ষতির আশঙ্কা করলে সেক্ষেত্রে যুদ্ধ শুরু করা যাবে, শত্রুরা সন্ধি করতে চাইলে বা তারা হারাম মাসে থাকলে মুসলিমগণের উচিৎ তাদের সাথে চুক্তি করা।” (সহজ ফিকহ শিক্ষা, জিহাদ পরিচ্ছেদ এর শেষাংশ, ইসলামহাউজ.কম প্রকাশনী)
লেখা বড় হয়ে যাওয়ায় দ্বিতীয় পর্বে থাকবে- “কুরআন-হাদিস অনুযায়ী নেতা হওয়ার শর্তসমূহ”।